জাদুঘর হলো একটি দেশের ঐতিহ্যের ধারক ও ভাণ্ডারস্বরূপ। জাদুঘর একটি দেশের ঐতিহ্যের ধারক বা ভাণ্ডার স্বরূপ। জাদুঘর একটি দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ। পৃথিবীর সব দেশেই তাদের আবহমান সংস্কৃতি ও জীবনসংগ্রামের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ জাদুঘরে সংগৃহীত থাকে। একটি দেশের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক সামাজিক ঐতিহ্য-এর সবকিছুই জাদুঘরের বিদ্যমান থাকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুঘরের নাম হলো ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম। এটি ১২০০ সালে নির্মিত হয়। এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগে প্রায় ২০০ বছর। এতে গ্রিক, মিশরীয়-রোমান ও প্রাচ্যদেশিয় অসংখ্য শিল্পনির্দশন রয়েছে। এর পাশাপাশি সংরক্ষিত আছে মধ্যযুগ, রেনেসাঁস ও আধুনিককালেরও বহু বিখ্যাত শিল্পী ও ভাস্করের শিল্প ও ভাস্কর্য কর্ম। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ ল্যুভর মিউজিয়ামেই সংরক্ষিত আছে। এ মিউজিয়াম সম্পর্কে এরকম একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, যিনি ল্যুভর পরিদর্শন করেছেন, ধরে নিতে হবে তিনি মাত্র অল্প ক’দিনের মধ্যে সারা বিশ্ব পরিদর্শন করেছেন।
বাংলায় জাদুঘরের ধারণা এসেছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। কেবল বাংলা নয় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে জাদুঘরের ইতিহাসের সূচনা ১৭৯৬ সালে। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যগণ এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূ-তাত্ত্বিক এবং প্রাণী সম্বন্ধীয় নমুনা সংগ্রহ এবং সেগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন অনুভব করেন। এভাবে ১৮১৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম জাদুঘর ‘এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
দেশের সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হিসেবে বাংলাদেশে রয়েছে বেশকিছু জাদুঘর। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের কুমার শরৎকুমার রায় প্রতিষ্ঠা করেন রবেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। শাহবাগে ১৯৮৩ জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। এ জাদুঘরের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস তুলে ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি করা যাতে করে তারা বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮০টিরও বেশি জাদুঘর রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘর, ঢাকা নগর জাদুঘর, নওগাঁর পাহাড়পুর প্রত্নস্থল জাদুঘর, সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর, ময়মনসিংহে অবস্থিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, কুষ্টিয়ার লালন জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, রংপুরের উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, সুনামগঞ্জের হাসন রাজা জাদুঘর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জাদুঘর কোনো দেশের ইতিহাসের ধারক ও বাহক। জাদুঘরে উপকরণ হিসেবে এমন সব বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয় যা অন্তত শতাধিক বছরের প্রাচীন এবং যার সঙ্গে শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং মানুষের সামাজিক জীবনের যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জাদুঘরে সংরক্ষিত উপকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে; দাপ্তরিক নথিপত্র, বইপত্র, মানচিত্র, রেখাচিত্র, মাদুর, খেলনাসামগ্রী, তলোয়ার, ছুরি, বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, চিত্রকর্ম, হাতির দাঁতের তৈরি সিংহাসন, গয়নার বাক্স, তাম্রপাত্র, বিভিন্ন দেবদেবির মূর্তি, ধাতব পদার্থের তৈরী বিভিন্ন তৈজসপত্র, ছুরি, মুদ্রা, কাঠের আসবাবপত্র, বিভিন্ন সময়কার মুদ্রা, বিচিত্র নকশার টেরাকোটা, স্থাপত্যকর্ম, লিপিকলা সংবলিত স্থাপত্যকর্ম ইত্যাদি। এগুলোর সবই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক।
ঢাকার শাহাবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর। আট একর জমির ওপর নির্মিত চার তলা ভবনের তিন তলা জুড়ে রয়েছে ৪৩টি গ্যালারি। জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশের মানচিত্র, ভাস্কর্য, স্থাপত্য নিদর্মন মুদ্রা, পদক ও অলঙ্কার, গ্রামীণ বাংলার দৃশ্যাবলি, সুন্দরবনের পরিবেশ-বৈচিত্র্য, শিলা ও খনিজ নিদর্শন, গাছপালা, ফুল-ফল, জীবজন্তু, পাখি, হাতি, নৌকা, উপজাতিদের জীবনযাত্রা, মাটির পাত্র, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম, পোড়া মাটির শিল্পকর্ম, বীরদের প্রতিকৃতি, ঐতিহাসিক দলিলপত্র, বিশ্ব মনীষীদের প্রতিকৃতি প্রভৃতি জাতীয় জাদুঘরের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে; পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের টেবিল, ভাষা আন্দোলনের শহীদ আবুল বরকতের রক্তমাখা শার্ট ও জুতা, ঢাকাই মসলিন, লালমাই ও ময়নামতি থেকে প্রাপ্ত প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছরের প্রস্তর খণ্ড, ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে নিক্ষিপ্ত আনবিক বোমার খণ্ডাংশ, হাতির দাঁতের পাটি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন, ভাষা আন্দোলনে শহীদদের ব্যবহৃত জিনিস, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিগত স্মৃতি-নিদর্শন, পোড়ামাটির ফলক ও ভাষ্কর্য এবং বিবিধ মূর্তিসহ সমকালীন শিল্পকলার সংগ্রহ।
জাদুঘর বর্তমানের সাথে অতীতের যোগসূত্র স্থাপন করে। জাদুঘরের মাধ্যমে আমরা অনেক জ্ঞান লাভ করতে পারি। একটি জাতির ঐতিহ্য খুঁজে পেতে হলে জাদুঘরের বিকল্প নেই। এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষে যেমন বিশ্বের খবর লিপিবদ্ধ থাকে, আর জাদুঘরে অতীত জীবন্ত হয়ে দর্শকদের সামনে হাজির হয়। জাদুঘর থেকে আমরা অনেক জ্ঞান লাভ করতে পারি। এদিক থেকে জাদুঘরের প্রয়োজন অসামান্য। জাদুঘর না হলে একটি জাতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া অসম্ভব।
একটি দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও জাতীয় ঐতিহ্যের যথাযথ সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনই জাদুঘরের লক্ষ্য। জাদুঘর দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে জনসম্মুখে তুলে ধরার মধ্যদিয়ে অতীত ও বর্তমানের সেতু বন্ধন করে। তাছাড়া জাদুঘরের মাধ্যমে একটি দেশের জনগণ তাদের অতীতকে, তাদের বীরদেরকে স্মরণ করতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। এজন্য সবারই জাদুঘরে যাওয়া প্রয়োজন।