যারে তুমি নিচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
মূলভাব : মানব জাতির সভ্যতার ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক গতিপথ প্রতিক্রিয়ার অসংখ্য নজির দ্বারা চিহ্নিত। লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ একে অপরের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত।
সম্প্রসারিত ভাব : বিশ্বের মানব সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। এ শ্রেণীবিভক্তি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। ধর্ম, বর্ণ, পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এ শ্রেণীভেদ সৃষ্টি করে থাকে। হিন্দু-মুসলমান, আরব-ইহুদি, সাদা-কালো, আর্য-অনার্য, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ইত্যাদি বর্ণগত ও জাতিগত পার্থক্য ও ভেদাভেদ বিদ্যমান।
মানবসমাজের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় এ জাতিভেদ, শ্রেণীভেদ ঘৃণা ও বিরোধ। উচ্চ শ্রেণী, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি প্রভৃতি দিক থেকে তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীকে বঞ্চিত করতে চায়। এর ফলে মানবসমাজের একটা বৃহৎ অংশে মনুষ্যত্বহীন স্তরে অবমাননায়, লাঞ্ছনায় ও দারিদ্র্যে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। তা সমগ্র সমাজের ও দেশের উন্নতি এবং মানবকল্যাণের পরিপন্থী। দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যা যেখানে অশিক্ষার অন্ধকার ও হেয়তায় কুসংস্কারে এবং অমানবোচিত জীবনযাত্রায় অবনমিত, সেখানে স্বল্পসংখ্যক উচ্চবিত্তের সংস্কৃতি-উজ্জ্বল জীবনেও তার মসীচিহ্ন পড়তে বাধ্য। কারণ সমাজ একটা যৌথ-জীবনধারা; একের জীবনচর্চা ও ধারা অপরকে সেখানে প্রভাবিত করবেই। তাছাড়া বঞ্ছিত, অবহেলিত শ্রেণীর মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ অনেক সময় বিদ্রোহ-বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করে থাকে। তাতে সমাজ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীর বহু প্রাচীন সভ্যতা এ কারণে বিনষ্ট হয়েছে।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
ভাব-সম্প্রসারণ : জীবনের পরিপূর্ণ সার্থকতার পেছনে রয়েছে সমষ্টিগত সহযোগিতা। জীবনকে সার্থক বিকাশ ও পরিপূর্ণ সফলতার জন্য সকলের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কাউকে পেছনে ঠেলে একা সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা অনুচিত।
মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, সেহেতু সমাজ জীবনে পরস্পরে একে অপরের ওপর নীর্ভরশীল, ফলে পরস্পরের সহযোগিতা ছাড়া কেউ চলতে পারে না। কিন্তু সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যারা স্বার্থবুদ্ধি, সঙ্কীর্ণতা ও অনুদারতাবশত অন্যদের কেউ চলতে পারে না। কিন্তু সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যারা স্বার্থবুদ্ধি, সঙ্কীর্ণতা ও অনুদারতাবশত অন্যদের কথা না ভেবে, তাদেরকে পেছনে ফেলে রেখেই এগিয়ে যেতে চায়। সে শুধু নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় তখন অপরের ক্ষতি সাধনে তৎপর হয়, অন্যের বড় হওয়ার পথেও বাধার সৃষ্টি করে। ফলে ব্যক্তি ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্তরা জাতির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে রাখে। তাছাড়া বঞ্চিত ও অবহেলিত শ্রেণীর মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ অনেক সময় বিদ্রোহ-বিপ্লবে রূপ নেয়। কারণ, যাকে নিচে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় প্রকৃত অর্থে এই এগিয়ে যাওয়াটা নিষ্কণ্টক নয়। বস্তুত কাউকে নিচে ফেললে সে নিচ থেকে আটকে রাখে। তখন উপরে ওঠার সুযোগ থাকে না। তেমনি কাউকে পেছনে ফেললে সে পেছন থেকে টেনে ধরে। তখন সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। তাই টানাটানি যদি পরিহার করা যায় তাহলে উভয়ের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। সুতরাং কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এর মধ্যেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।
একা বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। সেজন্য সকলকে সুযোাগ দিতে হবে, সকলের জন্য ভাবতে হবে। ‘আগে-পিছে’র প্রতিযোগিতায় না গিয়ে সবাই মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কেননা সকলের সম্মিলিত উদ্যোগের ফলে শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়, লক্ষ্য অর্জনে সফল হওয়া যায়।