পুরাকীর্তি : পাহাড়পুর
ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি সুপ্রাচীন দেশ। পাচীনত্বের গরিমায় বাংলা সারা বিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দারুণভাবে উন্নতিলাভ করে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী রাজাদের শাসনামলে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় এবং ঐ প্রবাহিত ধারা দেশের সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং সেই ধারার প্রতি অনুরাগী ও নিষ্ঠাবান করে তোলে। সেন রাজাদের পূর্বে যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা ধীর্ঘকাল ধরে বাংলা শাসন করেন তখন তাঁদের আমলে ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশিল্পের দারুণ উন্নতি হয়। ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার জন্যে ঐ যুগে দূরদেশ থেকে বহু পর্যটক পায়ে হেঁটে বাংলায় আসেন এবং তখনকার দিনের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। চীন দেশের পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাং এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সেই সময় বাংলায় স্বর্ণযুগ বিদ্যমান ছিল।
পাহাড়পুরের পুরাকীর্তি : বৌদ্ধ যুগে রাজশাহী জেলার পাহড়পুরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের যে আশ্রম নির্মিত হয়েছিল তা কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে ধ্বংসস্তূতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু কিছু পুরাকীর্তি আবিষ্কার করা হচ্ছে। মাটির সীলমোহরে খোদিত লেখা থেকে চিহ্নিত হয়েছে, সোমপুর বিহারটি পাল রাজা ধর্মপালের আমলে তাঁর অর্থ আনুকূল্যে নির্মিত। হিমালয়ের দক্ষিণে এটাই সবচেয়ে বড় বিহার। এ বিহারটি উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। এই চতুষ্কোণ আশ্রমটিতে ১৭৭টি কক্ষ ছিল। এ-সব কক্ষে বৌদ্ধ-ভিক্ষুরা বাস করতেন এবং শাস্ত্র চর্চা করতেন।
পাহাড়পুর আশ্রমটি ছিল ২২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর বাইরে চারদিক ঘিরে ছিল ১৬ ফুট পুরু একটি দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে ছিল ১৭৭টি কক্ষ। প্রত্যেকটির আয়তন ছিল ১৪′x১৩.৫০′। কক্ষগুলোর সামনে ছিল একটা ৯ ফুট বিস্তৃত বারান্দা।
আশ্রমটির উচ্চতা ছিল ৭২ ফুট এবং এটি তিন স্তরে নির্মিত হয়েছিল। যে দেয়াল দ্বারা আশ্রমটি বেষ্টিত ছিল সে-দেয়ালের উপরে সাজানো ছিল একসারি ৬৩টি পাথরের মূর্তি। এ মূর্তিগুলোতে ব্রাহ্মণ ধর্মের ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। মূর্তিগুলোর উপরের দিকে টেরাকোটার চিত্র ছিল। চিত্রগুলোতে ছিল লোকশিল্পের ছাপ। পাথরের ভাস্কর্য মূর্তিগুলোতে যে শুধুমাত্র লোকশিল্পের ছাপ ছিল তা-ই নয়, এগুলোতে ছিল রামায়ণ ও মহাভারতের প্রভাব ও শ্রীকৃষ্ণের জীবনীকেন্দ্রিক চিত্র।
আশ্রম গাত্রে যে-সকল চিত্র অঙ্কিত ছিল তার মধ্যে টেরাকোটা শিল্পের প্রধান্য অধিকমাত্রায় বিদ্যমান। খনন কার্যের মাধ্যমে ২০০০ হাজার টেরাকোটা চিত্রের প্লেট পাওয়া গেছে।
ঐতিহাসিক মূ্ল্যবান এবং স্থাপত্যের উৎকর্ষ বিচারে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের গরিমা অতুলনীয়। এখনকার বৌদ্ধ বিহারের গঠন-সৌষ্ঠবে যে মন্দির-স্থাপত্যের মহিমা পরিব্যাপ্ত তা সারা বিশ্ব পরম বিস্ময়ের সাথে স্বীকার করে। মন্দির স্থাপত্যের এই মহিমান্বিত শৈলী ধীরে ধীরে সুদূর পূর্বদেশে বিস্তারলাভ করে। পাহাড়পুর প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য গরিমার একটি জ্বলন্ত প্রতীক।
উপসংহার : পাহাড়পুরের মন্দির, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ আশ্রম, আশ্রমের কিছুদূরে সত্যপীরের ভিটা, প্লেটের উপর তাম্রলিপি ও ব্রোঞ্জ-নির্মিত মূর্তি এ সব পুরাকীর্তির নিদর্শন পাহাড়পুরের গরিমা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবী স্বীকার করেছে যে, পাহাড়পুর তথা বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি অতি সুপ্রাচীন যখন বর্তমানের সভ্য দেশগুলোতে সভ্যতার কোনো আলো দেখা দেয় নি।
পুরাকীর্তি : মহাস্থানগড়
ভূমিকা : একটি দেশের পুরাকীর্তি সেই দেশের অতীতকালের সাক্ষ্য বহন করে। দেশটি কত উন্নত ছিল, তার কৃষ্টি-সংস্কৃতি কত উৎকর্ষ লাভ করেছিল, সে সম্পর্কে সে দেশের পুরাকীর্তি যে সাক্ষ্য তুলে ধরে তার ওপর ভিত্তি করে সে দেশের সভ্যতার মান নির্ণীত হয়। এমনি একটি পুরাকীর্তির পরিচয় বহন করে আমাদের দেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়।
অবস্থান : বগুড়া জেলার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ করতোয় নদীর তীরে এবং ঢাকা-দিনাজপুর বিশ্বরোডের পাশে এই ঐতিহ্যবাহী মহাস্থানগড় অবস্থিত। সমতল ভূমি থেকে এই গড় প্রায় ২০/২৫ হাত উঁচু হবে। প্রাচীন যুগের বহু ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান। বিভিন্ন সময় খনন করে এ গড় থেকে পাথর, মূর্তি, শিলা, ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন আমলের মুদ্রা পাওয়া গেছে। মহাস্থানগড় যে পুরাকীর্তির একটি অন্যতম নিদর্শনস্থল তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইতিহাস : অতি-প্রাচীন কালে ‘পুণ্ড্ররাজ্য’ নামে এক রাজ্য ছিল। এই পুণ্ড্ররাজ্যের সীমানার মধ্যে ছিল রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, বালুরঘাট, মালদহ, কুচবিহার প্রভৃতি স্থান। এই রাজ্যে এক এক সময় এক এক রকমের নামকরণ করা হয়েছিল; কখনও হয়েছিল বরেন্দ্রভূমি, কখনও-বা গৌড়রাজ্য। উত্তর বাংলার নাম ছিল পৌণ্ড্রবর্ধন। রামায়ণ-মহাভারতেও পৌণ্ড্রবর্ধনের নাম উল্লেখ আছে।
শশাঙ্ক নামে এক বাঙালি রাজা একসময় পুণ্ড্ররাজ্য দখল করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি মালদহ জেলার গৌড়ে প্রধান রাজধানী স্থাপন করেন। তখন পৌণ্ড্রবর্ধন প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পরশুরাম নামে এক হিন্দুরাজা পৌণ্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন। ইতিহাস-বিখ্যাত মহাস্থানগড় রাজা পরশুরামের আমলেই সমৃদ্ধিলাভ করে। মহাস্থানগড় ছিল করতোয়া নদীর তীর ছুঁয়ে একটি মনোরম স্থান। এ-স্থানটিকেই রাজা পরশুরাম রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করতেন। হিজরী ৪৪০ সনে হযরত শাহ সুলতান ইব্রাহিম বলখী মাহীসওয়ার (র) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেন। অতঃপর ধাপ-সুলতানগঞ্জ নামক স্থানে তিনি আস্তানা স্থাপন করেন। এখানে ইসলাম প্রচারের সময় তাঁর সঙ্গে রাজা পরশুরাম ও তাঁর ভগ্নি শীলাদেবীর ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা পরশুরাম নিহত হন এবং তাঁর ভগ্নি শীলাদেবী মন্দিরের পিছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে করতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর ফলে এখানকার অগণিত লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
৪৪৭ হিজরী সনে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার (র) এখানে ইন্তেকাল করেন। এখানে তাঁর মাজার রয়েছে। সুলতান সাহেবের মাজারের নিচেই তাঁর প্রধান খাদেমের কবর করেছে। এখানে আর একজন দরবেশের মাজার আছে, তাঁর নাম ছায়াতপুর। গড়ের একটু দক্ষিণে দরবেশে বোরহান উদ্দিনের মাজার। তারপর গোকুলের ম্যাড, বেহুলা সুন্দরী ও লখিন্দরের বাসরঘরের ধ্বংসাবশেষ; পশ্চিমে কালিদহ সাগর ও বাসোবনিয়া সওদাগরের বাড়ি, উজানী-ভাইটালী নগর।
এছাড়া, উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে- শীলাদেবীর ঘাট ও রাজা পরশুরামের সভাগৃহের ধ্বংসাবশেষ। শীলাদেবীর ঘাট হিন্দুদের তীর্থস্থান। এখানে প্রতিবছর মেলা বসে এবং গঙ্গাস্নান করা হয়। পরশুরাম রাজার জীয়ৎকূল একটি আশ্চর্যজনক কূপ। কথিত আছে যে, এ কূপের পানি দিয়ে নাকি মৃত ব্যক্তিকে বাঁচানো যেত। বস্তুতপক্ষে, শীলাদেবীর জন্যেই আজ মহাস্থানগড় হিন্দুদের তীর্থস্থান এবং শাহ্ সুলতানের জন্যে মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র স্থান।
বর্তমান অবস্থা : মহাস্থানগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বহুসংখ্যক প্রাচীন নিদর্শন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে মুসলিম যুগের, শেষ পর্যন্ত বহু নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ খননকার্যের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন। এ-সব দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সত্যই মহাস্থানগড় একটি ইতিহাস-প্রসিদ্ধ স্থান।
উপসংহার : সুদূর অতীতের স্মৃতি বুকে ধরে মহাস্থানগড় ইতিহাসের পাতায় ঘুমিয়ে থাকলেও অনুসন্ধিৎসু মানুষ তাকে ভোলে নি। আজও বহু পর্যটক, বহু গবেষক এবং বনভোজন পার্টির আনাগোনায় ও ভিড়ে মহাস্থানগড় চঞ্চলতা ও আনন্দ-উল্লাসে মুখরিত। দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের গরিমা সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে এ-সব পুরাকীর্তির যথাযথ তত্ত্বাবধান খুবই প্রয়োজনীয়।